দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের কাছে ‘মাদিবা’ হিসেবে পরিচিত বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁর মধ্যে ছিল মহত্ত্ব ও সরলতার অদ্ভুত মিশ্রণ। তিনি ছিলেন হাস্যরসিক। সহজেই সব মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন। তাঁর গায়ের রঙিন জামা আর নাচের অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁকে সবার মধ্যে ভিন্ন করে তুলেছিল। সবাই একে ‘মাদিবা জাদু’ হিসেবেই জানতেন। নব্বইয়ের দশকে তাঁর অবসরের পরও এ জাদুতেই মুগ্ধ ছিল বিশ্ব।২০১৩ সালে পৃথিবী তার সর্বকালের সেরা সন্তানদের একজনকে হারায়। ওই বছর ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন শান্তি, সমঝোতা ও মিলনের প্রতীক, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের কুনু গ্রামে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন নেলসন ম্যান্ডেলা, যাঁর ৯৫ বছরের জীবনের দীর্ঘ ২৭টি বছরই কেটেছে নিপীড়ক শাসকের কারা প্রকোষ্ঠে। ১৯৪৪ সালে তিনি যোগ দেন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি সংগঠন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি)। শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে এএনসির সংগ্রামের মূল আদর্শ ছিল ‘সাদা-কালো ভেদাভেদ নেই, সব মানুষের সমান অধিকার’।সুদীর্ঘ সেই সংগ্রামের পদে পদে ম্যান্ডেলা নিগৃহীত ও নিপীড়িত হয়েছেন। তবে তিনি পিছিয়ে আসেননি। তাঁর জাদুর চাবিকাঠি দিয়ে বিশ্বজয় করেছেন।
অনেকেই ম্যান্ডেলাকে স্মরণ করেন ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ৭৫ বছর বয়সে তিনি দেশটির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে আর প্রার্থী হতে রাজি হননি তিনি। এর আগে ১৯৯৩ সালে এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান এই বর্ণবাদবিরোধী নেতা।তবে মহান এই নেতাকে মানুষ তাঁর বিশেষ স্টাইলের জন্যও মনে রেখেছে। এখনকার সময়ের বিখ্যাত মাদিবা স্টাইল তার কাছ থেকেই এসেছে। মাদিবা জাদুর সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত ছিল তার ঢিলেঢালা শার্ট। তাঁকে অন্য রাজনীতিবিদদের চেয়ে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করত এ শার্ট। মাদিবা শার্ট মূলত তাঁর গোত্রের নাম থেকে নামকরণ করা হয়।
মাদিবা আলোকচিত্রীদের কাছেও ভালোবাসা পেয়েছিলেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে আলোকচিত্রীদের মাদিবার ছবি তোলা নিষেধ ছিল। কারণ, রোবেন আইল্যান্ডে ১৮ বছরের বন্দিজীবনে চুনাপাথরের খনিতে কাজ করতে হয়েছিল তাঁকে। এতে তাঁর চোখ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তবে ১৯৯৯ সালে অবসরের পর তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতারা ছবি তোলার জন্য বায়না করতে থাকেন।তবে ২০০৩ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় মাদিবার সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ হারান। কারণ, মাদিবা যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকে হামলার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বুশ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তিনি এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি ঠিকমতো চিন্তা করতে পারেন না।’দক্ষিণ আফ্রিকার শিশু–কিশোরেরা মাদিবাকে খুব পছন্দ করতেন। তরুণদের প্রতি তাঁর বিশেষ সহানুভূতি ছিল। কারণ, তিনি বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়ে কারাগারে থাকায় তাঁর নিজের বেড়ে ওঠার দিনগুলো উপভোগ করতে পারেননি।নিজের গ্রাম কুনুতে ২০০২ সালে ম্যান্ডেলা যখন বড় দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, তখন ২০ হাজারের বেশি শিশু–কিশোর জড়ো হয়েছিল। অনেক দূরদূরান্ত থেকে এসেছিল তারা। যে প্যান্ডেমোনিয়ামে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল, তা পরিপূর্ণ হয়েছিল। এতে অনেকেই পদদলিত হয়। তিনজনকে হাসপাতালে নিতে হয়। ভিড় সামলাতে না পেরে নিরাপত্তাকর্মীদের বেড়া কেটে দিতে হয়।
মানুষের প্রতি ম্যান্ডেলার সহমর্মিতা ছিল দেখার মতো। অনেক অসম্ভাব্য মুহূর্তে তিনি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি একবার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক থামিয়ে অন্তঃসত্ত্বা এক সাংবাদিকের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন। তিনি প্রশ্ন করেন, তাঁর সন্তানের জন্ম হতে আর কত দিন আছে?মাদিবা নিজে যথেষ্ট হাস্যরসিক ছিলেন। নিজেকে নিয়েও মজা করতেন। ২০০০ সালে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমার মনিবরা বলত, কারাগারে ২৭ বছর রুটি বেলতে হবে। এখন সেগুলোর কিছুটা ধরার সময়।’১৯৯৮ সালে ম্যান্ডেলা একবার বলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে, আমি বিশ্বের হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হতে পারব না।’ ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ ফুটবলে যেতে না পারায় তিনি মজা করে বলেন, ‘আমাদের কমপক্ষে পান করার অধিকার তো আছে। আমরা পরবর্তী সময় অবশ্যই জিতব।’বর্ণবাদী শাসন নিয়ে আলোচকদের একজন রোয়েলফ মেয়ার বলেন, ১৯৯০ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই ম্যান্ডেলার ক্যারিশমা দেখেন তিনি। ওই সময় শ্বেতাঙ্গ অনেক সেনা তাঁর সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য সারি বেঁধে দাড়িয়েছিলেন। অথচ একসময় মাদিবা তাঁদের চোখে ‘সন্ত্রাসী’ ছিল।
এএফপি অবলম্বনে